চট্টগ্রামের উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে উঠা আদিল হোসেন নোবেল ঢাকায় আসেন ১৯৮৯ সালের দিকে। স্কুল আর কলেজের পাট চুকিয়ে তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক। এক কাজিনের পরামর্শে র্যাম্প মডেল হিসেবে শোবিজে অভিষেক হয়েছিল তার। ফ্যাশন শোতেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও অভিনেতা আফজাল হোসেনের। তার মাধ্যমেই মডেলিংয়ে নোবেলের হাতে খড়ি।
মডেলিংয়ে অভিষেক সম্পর্কে নোবেল বলেন, আফজাল হোসেন নির্মিত স্প্রাইটের একটি বিজ্ঞাপনে আমি প্রথম কাজ করি। টেকনিক্যাল কারণে ওই বিজ্ঞাপনটি প্রচার হয়নি । এরপর আফজাল হোসেনের নির্দেশনায় কাজ করি আজাদ বলপেনের বিজ্ঞাপনে। এটাই আমার প্রচার হওয়া প্রথম কাজ। ‘লোনলি ডে লোনলি নাইট’ শিরোনামের সেই বিজ্ঞাপনটি এতোই জনপ্রিয়তা পায় যে, এক বিজ্ঞাপনেই আমি সুপরিচিতি হয়ে যাই। এই একটি বিজ্ঞাপনই আমার নামের আগে যোগ করে দেয় মডেল শব্দটি। মডেলিংটাকে এনজয় করি বলেই এখন পর্যন্ত লেগে আছি।
দেশের মডেলিং সেক্টরে দুই দশক ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন নোবেল। এখন পর্যন্ত তিনিই দেশের সবচেয়ে দামি এবং নামী মডেল। এই সাফল্যের পেছনের রহস্যের কথা জানতে চাইলে নোবেল বললেন, আমি সবসময় নিয়ম-নিষ্ঠা আর পরিমিতির মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছি। ইচ্ছে করলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একের পর এক বিজ্ঞাপন কাজ করে যেতে পারতাম। এতে আর্থিকভাবেও হয়তো লাভবান হতাম। কিন্তু কখনোই আমি এমনটি ভাবি নি। যে কোনো কাজ করার আগে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করেছি।
প্রতিদিন আমাকে শুটিং করতে হবে, কাজ করতে হবে, এমনটি আমি মাথায় আনিনি। আমি সব সময় চেয়েছি, প্রতিটি কাজে বৈচিত্র্য আনতে এবং যেটা করব সেটা ভালোভাবে বুঝে মনোযোগ দিয়ে করব।
এ প্রসঙ্গে নিজের কাজের একটি উদাহরণ তুলে ধরে নোবেল বলেন, একটি বিজ্ঞাপনে আমাকে বক্সারের চরিত্রে রূপদান করতে হবে জানলাম। আমি নিজের উদ্যোগেই আমার পরিচিত এক বক্সারের কাছে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়ে বক্সিংয়ের কলাকৌশলগুলো রপ্ত করি। তারপর ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রায় প্রতিটি কাজেই আমি আগে নিজেকে এভাবে প্রস্তুত করি।
নোবেল যখন মডেলিংয়ে আসেন তখন তিনি টগবগে তরুণ। এর ২০ বছর পরে পৌছে তার মধ্যে হয়তো বয়সের একটা ভারিক্কি এসেছে, কিন্ত মিইয়ে যায়নি তারুণ্য। আশ্চর্যভাবে তিনি ধরে রেখেছেন ফিটনেস। এ বিষয়ে নোবেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমি নিয়ম মেনে পরিকল্পনা অনুযায়ী জীবনযাপন করি। কখনোই আমি নিজস্ব সেই খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসি নি। এক দিন গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করলাম, আর পরের দিন দুপর পর্যন্ত ঘুমালাম। একদিন খেলাম না তো পরের দিন একগাদা খাবার খেয়ে ঘুমালাম, এটা আমার অভ্যাস নয়। আমি প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম, সুইমিং, জিম, সময়মত খাওয়া, রেস্ট নেয়া এবং অফিস করা সবই ছক বেঁধে করি। আজ পর্যন্ত আমি কারো দেওয়া ডেট অনুযায়ী কাজ করিনি। আমার ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে শুটিং করেছি। চাকরি ঠিক রাখার পাশাপাশি শোবিজের ক্যারিয়ারটাও তাই ঠিক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞাপনের বাইরেও মাঝেমধ্যে কিছু নাটকেও অভিনয় করে থাকেন। নোবেল অভিনীত প্রথম নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’। ১৯৯৫ সালে প্রচারিত এ নাটকটি ছিল প্যাকেল প্রোগ্রামের আওতায় দেশের প্রথম টিভি নাটক। এরপর মাঝে মধ্যেই তিনি নাটক করেছেন, তবে তা বিশেষ বিশেষ দিবসে। এখনও তার নাটকে কাজ করার ইচ্ছে আছে, তবে ঈদ বা বিশেষ দিবসকে ঘিরে। গত ১৫ বছরে নোবেল অভিনীত নাটকের সংখ্যা বড়জোর বিশ।
টিভি নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মডেল হয়েছি আমি ঘটনাচক্রে। কিন্তু এটাকে জীবনের অবলম্বন করিনি। কাজ পছন্দ হলেই শুধু কাজ করেছি। ইচ্ছে ছিল না অভিনয়ের। কিন্তু শুরুতে এমন কিছু জায়গা থেকে অনুরোধ আসলো যে, নাটকে অভিনয় করতেই হলো। তারপর একবার যখন করলাম, তখন হাতে সময় থাকলে কাজটা ভালো হলে না করি না। তবে বিশেষ বিশেষ নাটকেই আমি শুধু অভিনয় করি। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেই নি, আর দেবোও না।
বিজ্ঞাপন আর নাটকের বাইরে নোবেল সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব। কিন্তু চলচ্চিত্র তাকে আকর্ষণ করে নি বলেই কাজ করা হয়ে উঠে নি। এ প্রসঙ্গে নোবেল বললেন, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ব্যাপারে বহু প্রস্তাব আর অনেক চাপের মধ্যে আমাকে পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমি কখনোই সিনেমার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিনি। আর যেসব প্রস্তাব নিয়ে আমি দু-একবার ভেবেছি, সেগুলোর প্রস্তুতি দেখে আমি হতাশ হয়েছি বলেই সিনেমা থেকে দূরে থেকেছি।
এই সময়ের বিজ্ঞাপন সম্পর্কে নোবেলের মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, , এখন অনেক ভালো ভালো বিজ্ঞাপন হচ্ছে। আগে হতো বিনোদন বিজ্ঞাপন। অর্থাৎ নাচ গান দিয়ে। আর এখন হচ্ছে থিমভিত্তিক। এ ধরণের বিজ্ঞাপনগুলো দর্শকরাও বেশ ভালোই গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু কাজগুলো সেভাবে আলোচনায় না আসার কারণ হলো, এখন এতো বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে যে দর্শকদের পক্ষে ভাল-মন্দ বাছাই করাটা হয়ে উঠেছে কঠিন।
বর্তমানে নোবেল ওয়ারিদের কর্পোরেট অ্যান্ড এসএমই সেলস ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে এমজিএইচ গ্রুপের শিপিং ডিভিশনে। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কোটস বাংলাদেশ লিমিটেডে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে প্রায় ১২ বছর কর্মরত ছিলেন। একাডেমিক পর্যায়ে নোবেল ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। এছাড়াও তিনি সিঙ্গাপুর ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এবং জেভিয়ার লেবার রিলেশনস ইন্সটিটিউট থেকে ‘কি অ্যাকাউন্টস ম্যানেজমেন্ট’ এর উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।