কালের স্বাক্ষী হাজী জহিরউদ্দিন..
মুন্সীগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার হাজী জহিরউদ্দিনের বাড়ির চারপাশে কলা আর কলা গাছে ঢেকে থাকতো। গোটা বাড়িটা হয়ে উঠতো কলার বাগান। বাড়ির পেছনে কিবা সামনে কোথাও তিল পরিমান ফাঁকা জায়গা খালি রাখতো না ওই কলা চাষী। তবে তিনি শখের বশেই ওই কলা চাষাবাদ করতেন। এখন তিনি নেই। আছে তার বাড়ি। আছে ছেলে-মেয়ে। আছে নাতী-নাতনী। কিন্তু তার অবর্তমানে সেই শখের কলা ধরে রাখতে পারেননি এ প্রজন্ম। তার সঙ্গে রামপালের কলাও হারিয়ে গেছে। কালের আবর্তে হাজী জহির উদ্দিনের মতো আরো অনেকেই আজ পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। অথচ তাদের সেই বিখ্যাত কলা হারায় যখন-তখন কেইবা বলবে সেই ইতিহাসের কলার কথা। রামপাল মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের এক অজঁপাড়া-গা। এখানকার অভিবাসীরা কলা চাষে যত না লাভ পেতেন, তার থেকে বেশী আতœতৃপ্তি দেখা যেত তাদের বুকের গভীরে। রামপালের সেই কলার ভিটা এখন আর চোখে পড়ে না। বাগান তো অনেক দুরের ব্যাপার। একটি বাগানও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না রামপালে। বিংশ শতাব্দি বলি কেউ। আবার কেউ বলি একবিংশ শতাব্দি- তো ওই তক্কে না গিয়ে বলা যায় ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক বড় ধরনের ধাক্কা লাগে রামপালের কলা চাষাবাদে। ওই সময়টাতেও প্রতিটি বাড়ি ছিল এক একটি কলার বাগান। সময়ের বিবর্তনের কাছে হার মানে রামপালের কলা। এইতো আমাদের কালের কন্ঠ-রামপালের কলা। রামপালের মানুষজন কলা চাষে আগ্রহ হারাতে বসে ওই সময় থেকেই। হারানোর একটা কাল সময় পাওয়া গেলেও কবে থেকে রামাপলে কলা চাষ শুরু হয় তার সঠিক সময় জানা নেই কারো। কে বা কারা প্রথমে ওই কলা চাষের প্রচলন শুরু করে তাও জানা নেই। কলা যে সুস্বদু খাবার তার বোধ করি রামপালের কলাই প্রথমে জানান দেয়। এতই মধুর এর স্বাদ, গন্ধ মানুষ মাত্রই তা খেতে ইচ্ছে করে। এরপরে খাওয়া গেলে তো কথাই নেই-মন জুড়ানো,প্রান জুড়ানো রামপালের কলা কথা মনে রাখা চাই সকলের। তবে এখন আর কেউ সেই কলার কথা বলেন না। এখন আর হাজী জহিরউদ্দিন খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন জহিরউদ্দিন কিংবা আরো বাগান বা ভিটা বর্তমানে খুঁেজ পাওয়া ভার।
নানু-দাদুর গল্পে..
নানু-দাদুর গল্পে শুনতাম আমরা রামপালের কলার কথা। ছোট্ট বেলায় সেই গল্প বলার মধ্যে শুনতে আমাদের যেমন ভালো লাগতো-তেমনি গল্প বলে কেমন জানি আনন্দ বোধ করতেন আমাদের নানু-দাদুরা। গ্রামে গঞ্জে নগর বন্দরে রামপালের কলার সুঘ্রান মিশে থাকতো। ওই গল্পের কথা একটা সময়ে যে সত্যি পুলকিত করার মতো ছিল। আবার ওই গল্প শেষে এখন রামপালের কলা হারিয়ে যাওয়ার গল্পও সত্যি হয়ে উঠেছে। নানু-দাদুর গল্পের ফারাকটা হচ্ছে এই যে- তারা আনন্দ পেতেন আর এখনকার গল্পে কলার ইউতিহাস বিলোপের দুঃখ ভারাক্রান্ত। রামপালের কলার ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে নানু-দাদুর গল্প। এক সময় এ জেলার কলার বেশ নাম-ডাক ছিল। সদর উপজেলার রামপালের কলা সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিল অতি পরিচিত। এখান থেকেই বিভিন্ন জাতের কলা বিদেশেও পাঠানো হতো । এমন এক সময় ছিল যখন এ এলাকার চাষযোগ্য জমি প্রায় সবটুকুতেই হতো কলা চাষ। রামপালের কলা চাষ কখন কিভাবে প্রথম শুরু হয় তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি ।
ডিঙ্গি-নৌকোয় কলা...
মুন্সীগঞ্জের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। দেশের দনিবঙ্গের ও রাজধানীর নৌ-যোগাযোগের ট্রানজিট পয়েন্ট নদীবেষ্টিত মুন্সীগঞ্জ। পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী পরম মমতায় জড়িয়ে আছে মুন্সীগঞ্জ। ঝালকাঠি,বরিশাল, খুলনা, চাঁদপুরসহ দনিাঞ্চলের মানুষজন রাজধানী ঢাকায় ছুটতেন এই রামপালের তথা মুন্সীগঞ্জের বুক দিয়েই। বড় বড় লঞ্চ, ষ্টিমারগুলো যখন মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটের কাছে ভিড়তো বা ভিড়ার অপোয় ঘাটের অদুরে থাকতো তখন ডিঙ্গি নৌকায় করে ফেরী করে বিকি-কিনি হতো এই রামপালের কলা। ডিঙ্গিতে ডিঙ্গিতে ফেরীওয়ালারা পসরা জমাতো রামপালের কলার। কলার হাক ডাকে মন কাড়া হতো লঞ্চ যাত্রীদের। তারপর ওই কলার স্বাদ নিয়ে কলা খেয়ে প্রান জুড়াতেন যাত্রীরা। ককনো কখনো ঘন্টার সময় ধরেও লঞ্চের নোঙর করা হতো ঘাটে। ওই দীর্ঘ সময়ের ফাঁকে দনিাঞ্চলের যাত্রীদের ঢাকার আত্মীয়দের বাড়িতে কিছু নিয়ে যাওয়ার পন্যের মধ্যে প্রথম পসন্দ ছিল রামপালের কলা। দ্বিতীয় কলকাতা হিসেবে খ্যাত মীরকাদিম নদী বন্দরে শত শত কোষা-নৌকায় করে বিক্রি করা হতো কলা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পাইকারা এখান থেকে কিনে নিতো ওই কলা। রামপালের কলা আর পাউরুটি ছিল যাত্রীদের কাছে এক অন্যন্য সাধারন তৃপ্তিদায়ক খাবার। তাই এ জন্য যাত্রী সাধারনের ভিড় লেগেই থাকতো সেখানে। কলার সুগন্ধে মৌ মৌ করত চারিধার। সাগর কলার যেমন সুগন্ধ তেমনই স্বাদ। এই আকর্ষণ আর লোভনিয় স্বাদ থেকে যেন কেউ নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইতো না। বরিশাল তথা দণি বঙ্গের রাজধানীর কলেজ পরুয়া শিার্থীসহ খেটে খাওয়া দিনমজুরদের কলা ও পাউরুটি ছিলো সকালের নাস্তা। দুপুরেও একই চিত্র ধরা পড়তো অলিতে-গলিতে গড়ে উঠা ছোট-বড় চায়ের ষ্টলগুলোতে। এখানে একটি রুটি বা বিস্কুট আর সাগর কলা দিয়ে সেরে ফেলতেন দুপুরের খাবার। অন্যদিকে অতিথি মুন্সীগঞ্জ এলেই সাগর কলার স্বাদ গ্রহণ করতে ব্যকুল হযে ওঠতো রামপাল তথা মুন্সীগঞ্জবাসী। অতিথি বিদায়কালেও তাদের সঙ্গে করে দিয়ে দেয়া হতো কলা।
কালের আবর্তে যেভাবে বিলিন কলার চাষ...
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে মাত্র ৫ বছর আগেও জেলায় ৫৭৫.৯৫ একর জমিতে কলা চাষ হতো। কলা চাষাবাদের জমিতে অধিক লাভজনক ফসল বুনতে শুরু করা থেকেই রামপালের কলার চাষ বিলীন হওয়ার পথে গিয়ে দাঁড়ায়। জেলার সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের রগুরামপুর এলাকার মো: আউয়াল বেপারীর সঙ্গে আলাপ কালে তিনি জানিয়েছেন- পরিবারের সবাই এক সময় কলা চাষ করতেন। তাদের পরিবারের ৫-৬ ঘরের লোকজন সকলেই ওই কলা চাষে আনন্দ খুজে পেতেন। অসাধারন লাগতো কলা চাষের ধরনও। বাড়ির আশপাশেরও কলা বুনতেন পরিবারের সদস্যরা। সেই সময়ে বেশ লাভজনকও ছিল কলা আবাদে। ফলাতেন বিভিন্ন জাতের কলা। এর মধ্যে ছিল সবরি কলা, কবরি কলা, সাগর কলা, চাপা কলা ও আনাজি কলা । তাদের চাষযোগ্য সবটুকু জমিতেই কলা চাষ হতো । কিন্তু ছিচকে চোরের উপদ্রুপ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে একটা সময়ে এসে তাদের কলা চাষের আয়োজেন ভাটা পড়ে। পর্যায়ে এসে তাদের কলা চাস বন্ধই হয়ে পড়ে। এখন সেখানে চাষ করা হচ্ছে নানা প্রজাতির সবজি। কালের আবর্তে যেখানে কলার চাষ করা হতো সেখানে আজ মৌসুমী ফসলের চাষ হচ্ছে । রামপাল বাজারের ব্যবসায়ী রমিজউদ্দিন শেখ ও আমজাদ শেখ জানান, তারাও এক সময় কলা চাষী ছিলেন । তাদের কলা মুন্সীগঞ্জ সহ লঞ্চ ও ট্রলার যোগে রাজধানি ঢাকা সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রির জন্য পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা নিয়ে যেতেন। এখন তাদের জমিতে সিজনাল সবজির চাষ হয় । এখন কলার বাগান হারিয়ে দখল করে আছে পানের বরজ। তবে ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায় সে লে পানের বরজের আশেপাশে তিন- চারটি কলা গাছ লাগিয়ে থাকেন বলে জানিয়েছেন তিনি । সরকার সহ স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরাই পারে পূনরায় এ কলা চাষে আমাদের সহযোগিতা করতে।
কলা চাষে আগ্রহ কমে আসার কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, নানারকম রোগ বালাই এবং চোরের উপদ্রবও বেড়ে গেছে । তাছাড়া আশপাশে যারা কলা চাষ করতো প্রতি বছরের বন্যায় তাদের কলা বাগান বিনষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে । এতে সরকারী ভাবে দৃষ্টি ও পৃষ্ঠপোশকতারও অভাব ছিল লনীয়। এরকম নানা কারনে দিন দিন কৃষকরা হতাশ হয়ে দিক-বিদিক হারিয়ে জেলার ঐতিহ্য রামপালের কলা চাষ আজ বিলুপ্তির পথে । বর্তমানে রামপাল ইউনিয়নের দিকে তাকালে দু’একটি ভিটা ছাড়া আর কোনও কলাবাগান চোখে পড়ে না । নেই সেই কলার মৌ মৌ গন্ধ।
ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায় আলাউদ্দিন মোল্লা...
এত কিছুর পরও মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের কুমারপাড়ার কলা চাষী আলাউদ্দিন তাদের বংশ পরমপরায় রামপালের কলার চাসের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান। পুরো নাম আলাউদ্দিন মোল্লা। তিনি কৃষক বটে-কলা চাষাবাদের জোক বেশ তার। এখানে তার একটা আলাদা ব্যাখ্যাও আছে। ইতিহাস কখনো মুছা যায় না বলেই তিনি মনে করেন। বিশ্বাস করেন তার পে সম্ভব রামপালের কলার সুনাম ধরে রাখা। আবার তার দেখা দেখি আরো অনেকে ফিরে আসবে কলা চাষে। এমনই তার ইচ্ছা। ফলে আলাউদ্দিন মোল্লার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বাংলাদেশ সময়ের এই প্রতিনিধিকে জানান, অর্ধ-শত বছর ধরে রেখেছে তার পরিবার এই কলা চাষ। আর্থিক সমস্যার কথাও তিনি বললেন। তাই চাই সরকারি সহযোগীতা। সরকারের পে কলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পদপে নেয়া জরুরীর কথাও বলতে তিনি ভুল করেননি। রামপালের মাটি সুস্বাদু কলা ফলে-এটা বিশ্বব্যাপী প্রবাদ। ওই প্রবাদের রকম ফের যেন না হয়। এই প্রত্যাশা চাষী আলউদ্দিনের। আর তাই তিনি রামপালের কলার ইতিহাসকে অম্লান রাখতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ আলাউদ্দিন।