লোকায়ণের চেয়ারম্যান ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জানান, বাংলাদেশের প্রাচীনতম এ অঞ্চলে ঐতিহ্য ও শ্রমজীবী মানুষের ঘাম ও রক্তের অনেক স্মারক ও ছড়িয়ে রয়েছে। অনাদীকাল থেকে এ জনপদের মুল চালিকা শক্তি হলো কিষাণ-কিষাণী, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতী, গ্রামীণ কবিয়াল আর আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাঁদের উৎপাদন, জীবন যাপন, বিনোদন আর লোকজ ঐতিহ্য স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। প্রচলিত অর্থে জাদুঘর বলতে বিভিন্ন শতাব্দী, কাল ও যুগের রাজা বাদশার প্রমাণ্য ঐতিহ্য ও বিবরণ থাকে। কিন্তু এই জাদুঘর লোকায়ণ তার ব্যতিক্রম। এই লোকায়ণে রয়েছে কৃষি উপকরণঃ যেমন- লাঙ্গল, মই, ফলা, দা, কাস্তে, হাতুড়ি, ছাম-গাইন, ডালা, খুন্তি, ধান রাখার ডুবি, ঢেঁকি ইত্যাদি। তাছাড়া আদিকালের দরজা-জানালা, চৌকি, খাট, হুক্কা, চিলিম, বল ম, বদনা, পাদুকা, থালা-বাটিও রয়েছে এখানে। বিনোদনের উপকরণের মধ্যে রয়েছে ঢাক-ঢোল, কাড়া-নাকাড়া, মাদল, মৃদঙ্গ, বাংলাঢোল, আকড়াই, একতারা, দোতরা, শানাই, বাঁশি ইত্যাদি। পালকি, টোপড়, ডুলি, মাঙ্গলিক উপকরণ, মঙ্গলসূত্র, চালনি, জায়নামাজ, তজবি, বলির দা, কোরবানীর ছুরি, পুঁথি, পাঁচালী, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, পত্রিকা, জমির দলিল, খারিজ, খাজনা আদায়ের রশিদ, একাডেমিক সার্টিফিকেট, মেডেল, প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ, চিঠি ও আলোক চিত্র ইত্যাদি ধর্মীয় উপকরণ ও ছাপানো উপকরণ এবং পান্ডুলিপি এই জাদুঘরে রয়েছে। পুরনো গরুগাড়ি ও চাকা, টাঙ্গা, ঘোড়ার চাবুক, হাতির হাওদা, বিভিন্ন সময়ের কড়ি ও ধাতব মুদ্রা ছাড়াও লোকায়ণে রয়েছে আদিবাসীদের মাটির অলংকার, পরচুলা, ক্লিপ, খোপা, নকশি কাঁথা, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশের ও খড়ের তৈরি পণ্য। আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক যেমন- বুলেটের খোসা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পোশাক ও চিঠিও এখানে রয়েছে। জাদুঘরে এমন অনেক প্রচলিত পুরনো জিনিস রয়েছে যা বর্তমানে সময়ের শিশু-কিশোর এখানে এসে দেখছে ও শিখছে। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে এই জাদুঘরের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দীন খান। এই লোকায়ণ জাদুঘরকে ঘিরে সারা বছর এখানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে জৈষ্ঠ্য মাসে ফল উৎসব, বর্ষার বরষা মঙ্গল উৎসব, মঙ্গা মোকাবেলায় আশ্বিন মাসে মঙ্গা কাল, অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব, মাঘ মাসে পিঠা উৎসব এবং চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত হয় ৩ দিন ব্যাপি লোকজ মেলা ও কবিগানের উৎসব। শ্রাবণের শেষে এখানে অনুষ্ঠিত হয় গেল বরষা মঙ্গল উৎসব। প্রতি বছরেই আয়োজন করা হয় এই উৎসবের। এই উৎসবে শিল্পীরা বর্ষার নানা গান পরিবেশন করেন, আবৃত্তিতে অংশ নেন স্থানীয় কবি সাহিত্যিকগণ। গত ২২ জুলাই লোকায়ণ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বরষা মঙ্গল উৎসব। জেলা প্রশাসক মুহা: শহিদুজ্জামান উৎসবের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, শহরের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ সহ সাংবাদিক ও কবি সাহিত্যিক গণ অংশ নেন। অতিথি বৃন্দের বক্তব্যের পর অনুষ্ঠিত হয় আবৃত্তি, নৃত্য ও সংগীতানুষ্ঠান। সাংস্কৃসিত অনুষ্ঠানে ইএসডিও’র শিল্পীগণ পরিবেশন করেন সঙ্গীত। পরে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনুযায়ী কলা পাতায় অতিথিদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা হয়।
লোকায়ণ জাদুঘর প্রাঙ্গণে ইএসডিও’র উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শিশু স্বর্গ। এখানে শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে অবকাঠামো। শহর থেকে দুরে গ্রামের এই শিশু স্বর্গ ভবিষ্যতে আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন চেয়ারম্যান স্বয়ং।