ফিচার ডেস্ক: নবীন প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে ফেসবুক৷ এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনই তথ্য৷ কী ভাবে বিষিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক?
তুমি আর আমি যাই...
কলেজ সেরে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছে লাবনী৷ বয়ফ্রেন্ড শামীম লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চাকরি করছে একটি পত্রিকায়৷ দু'জন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যাওয়ায় দৈনিক দেখা, রিকশায় হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ানোর পর্ব চুকে গিয়েছে বেশ কিছুদিন৷ তাই তাদের প্রেম বলতে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে চ্যাট বা রাতে ঘণ্টাখানেক ফোনে বাতচিত৷ আর মঙ্গলবার শামীমের ডে অফ, সে দিন বিকাল-সন্ধ্যা যুগলে মিলে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা। ব্যস, এ ভাবেই চলছিল সব৷ কিন্ত্ত বাঁক এলো কয়েক মাসের মধ্যেই৷
… 'তুমি কি আমায় সন্দেহ করো?' প্রশ্ন করে লাবনী 'এতে সন্দেহের কী আছে? বললেই তো হয়ে যায়৷' পাল্টা বলে শামীম… 'না কেন? কী দরকার তোমার?' 'আমিও আমার পাসওর্য়াডটা তোকে দিচ্ছি৷ তুইও দেখ, আমিও দেখি৷'…; 'সরি, আমার গোয়েন্দাগিরির কোনো শখ নেই৷ তুমি তোমারটা রাখো, আমি আমারটা৷' 'ও তার মানে এমন কোনো ব্যাপার আছে, যেটার জন্য তুই তোর ফেসবুক পাসওয়ার্ড আমায় দিবি না৷ দ্যাখ, আমার কিন্ত্ত কোনো ব্যাপার নেই৷ আমার পাসওর্য়াড তোর সঙ্গে শেয়ার করতে রাজি...' --- 'বেশি বোকো না তো ...তুমি এমন কোনো রামচন্দ্র নও যে, আমায় তোমার সামনে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে...৷'
ক্রমে সরে সরে...
লাবনী আর শামীমের সম্পর্কটা এখন ঠিক কী পর্যায়ে রয়েছে, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছে৷ প্রথমে মৃদু, তার পর সেই রেশ ধরেই বড় ভূমিকম্প৷ শেষে সম্পর্কে একটা লম্বা দাঁড়ি৷
এ ভাবেই কত শত লাবনী-শামীমের সম্পর্কের দফারফা হচ্ছে প্রত্যেক দিন৷ ভাঙনের নেপথ্যে প্রেমের চিরশত্রু অবিশ্বাস তো আছেই৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের জমানায় 'নবীন প্রেম' নষ্টে ইন্ধন জোগাচ্ছে ফেসবুকও৷ পারস্পরিক অবিশ্বাস-সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়ে তা সম্পর্ক বিচ্ছেদেও গড়াচ্ছে৷ এমন তথ্য উঠে এসেছে ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায়৷ যা শহরের ফেসবুকারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতেই পারে৷
ভেবে দেখেছো কি ...
বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩০০ ছাত্রছাত্রীর (যাদের বয়স ১৮-২৫এর মধ্যে) উপর এই সমীক্ষা চালিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগ৷ 'ফেসবুক অ্যাডিকশন অ্যান্ড ইটস এফেক্ট অন ইয়াং অ্যাডাল্টস ইন রোম্যান্টিক রিলেশনশিপ' শীর্ষক সমীক্ষাটি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের একজন অধ্যাপক নেতৃত্বে৷
সমীক্ষার প্রশ্ন নবীন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল৷ ওই ৩০০ জনের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক আবার নিজেদের ফেসবুক অ্যাডিক্ট বলে দাবি করেছেন৷ প্রতিটি প্রশ্নই পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নেয়া হয়েছিল৷
আরও কী কী তথ্য মিলছে ওই সমীক্ষা থেকে? গবেষকদের দাবি, ১৫০ জন ফেসবুক অ্যাডিক্টের মধ্যে ৭৩ শতাংশ ছেলেমেয়ে দাবি করেছেন, সোশ্যাল নেটওর্য়াকিংয়ের এই নেশার জন্যই তারা আরও বেশি করে নিজেদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পেরেছেন৷ তবে, এই ফেসবুকারদের মধ্যে ৬০ শতাংশ দাবি করেছেন, তারা নতুন নতুন সম্পর্কের খোঁজেই আরও বেশি বেশি করে ফেসবুক ব্যবহার করছেন৷ আরও বড় কথা হল, এই সব প্রণয়-সন্ধানী ফেসবুকার আবার নিজেদের প্রোফাইল ডিটেল ঘন ঘন পরিবর্তন করছেন৷ আর সেখান থেকেই তৈরি হচ্ছে 'মিথ্যা আত্মপরিচয়' প্রতিষ্ঠার প্রবণতা৷ কারণ অনেক সময়ই প্রোফাইলে যা লেখা, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বাস্তবের আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে৷ আর এখান থেকেই 'ফেক প্রোফাইল' তৈরি এবং প্রতারণার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে৷ তবে সমীক্ষা বলছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই প্রোফাইল ডিটেল পরিবর্তন করছেন বেশি৷ কারণ ফেসবুকে ছবি থেকে স্টেটাস, সব ক্ষেত্রেই লাইক ও বাহবা দেওয়া কমেন্টের জন্য মেয়েরা নাকি নিজেদের জোরালো আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন৷ সে কারণেই অনেক সময় মেয়েরা কোন ছবি, স্টেটাস বা প্রোফাইল ডিটেল আপডেট করলে বেশি লাইক ও কমেন্ট মিলবে, তা আগে থেকে ভেবে নিয়ে সেইমতো নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইল সাজাচ্ছেন৷
সমীক্ষা আরও বলছে, ৮০ শতাংশ শহুরে যুবা আবার দাবি করেছেন, তারা ফেসবুকের নানা 'অ্যাক্টিভিটি'র জেরে ঈর্ষা এবং নিরাপত্তাহীনতাতেও ভোগেন৷ কেন? সমীক্ষকরা জানাচ্ছেন, এই ঈর্ষা এবং নিরাপত্তাহীনতার নেপথ্যে আছে এক ধরনের মানসিক অবস্থা৷ কী সেটা? ধরা যাক, নন্টের প্রিয় বন্ধু ফন্টে ফেসবুকের ডিপিতে (ডিসপ্লে পিকচার) প্রচুর লাইক পেল৷ দেখাদেখি নন্টে যখন ডিপি পরিবর্তন করল তখন তেমন একটা লাইক তার কপালে জুটল না৷ সেখান থেকেই তিক্ততায় জড়িয়ে পড়ল নন্টে-ফন্টে৷ ঈর্ষাই যে এখানে আসল ভিলেন, তা পরিষ্কার৷
এসো খোলা জানালায়...
প্রেমের ক্ষেত্রটা অবশ্য আরও বেশি জটিল৷ ফেসবুক অ্যাডিক্টদের ৮০ শতাংশ দাবি করেছেন, তারা নিয়মিত তাদের সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীর প্রোফাইল ছানবিন করেন৷ এর ফলে অনেক সময়ই খর্ব হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা৷ কারণ চ্যাট বক্সে কে কার সঙ্গে কথা বলছেন, কী কথা হচ্ছে, কোন ধরনের ছবিতে সংশ্লিষ্ট সঙ্গী/সঙ্গিনী ট্যাগ হচ্ছেন বা শেয়ার করছেন… এই সব তথ্য শহুরে যুবারা নিজের ঘনিষ্ঠ সাথীর ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে বার করে ফেলছেন৷ আর এখান থেকেও জন্ম নিচ্ছে পারস্পারিক অবিশ্বাস৷ আদর্শ 'মরাল পুলিশ' হয়ে ওঠার প্রবণতাও বাড়ছে৷
সমীক্ষাই বলছে, মেয়েরা এই 'ফেসবুক পোলিসিং'-এর মাধ্যমে আসলে জানতে চাইছেন, তার সঙ্গী কোনো তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মানসিক ভাবে জড়িয়ে পড়ছেন কি না৷ মেয়েদের এ হেন আচরণ অবশ্য নানা ধরনের সামাজিক চাপ থেকেই তৈরি হচ্ছে৷ ছেলেরা আবার এই 'প্রোফাইল চেক'-এর মাধ্যমে দেখে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গিনীর সঙ্গে শারীরিক ভাবে কেউ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে না তো? পারস্পারিক এই নজরদারি থেকেও ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটছে আকছার৷ পিছু হটছে প্রেম৷ শেষে ধরাশায়ী সম্পর্ক৷ ফেসবুক আসক্ত নবীন প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকারা সমীক্ষার তথ্যগুলো মাথায় রাখতে পারেন !- ওয়েবসাইট।