ঢাকা: সাভারের অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১২৫ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এদিকে সরকারিভাবে নিহতের সংখ্যা ১০৯ বলে জানানো হয়েছে। এ পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে প্রায় অর্ধশত শ্রমিক।
নিহত ৫৮ শ্রমিকের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ফায়ার ব্রিগেড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ওই ৯তলা বিশিষ্ট গার্মেন্টসে তাদের উদ্ধার তৎপরতা শেষ করেছেন। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কারখানার সূতা ও কাপড়ের গোডাউনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট ৫ঘন্টা চেষ্টার পর রাত পৌনে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
তবে আহতের সংখ্যা দেড়’শ ছাড়িয়েছে। নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারিতে পুরো এলাকায় হৃদয় বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নিহতরা আগুনের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে এবং আগুনে পুড়ে ও শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেডের কারখানাটি র্যাব-শিল্প পুলিশ, বিজিবি ও থানা পুলিশ ঘিরে রেখেছে।
প্রাণহানির ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন।
রাত থেকে উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যরা।
ইতিমধ্যে শনাক্তকৃত ৫৫টি লাশ নিহতদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রত্যেকটি লাশ হস্তান্তর করার সময় স্বজনদের ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ মহা-পরিদর্শক মিজানুর রহমান রবিবার সকালে জানান, সব মিলিয়ে ১১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদেহগুলো উদ্ধারের পর নিহতদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করতে স্থানীয় নিশ্চিন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে রাখা হয়েছে এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুর হয়েছে বলে জানান তিনি।
শিল্প পুলিশের উপ-পরিচালক মোক্তার হোসেন জানান, উদ্ধার তৎপরতায় দেরি হওয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় লোকজন ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের গাড়িতে হামলা চালায় এবং কর্মী ও পুলিশ সদস্যদের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশ লাঠিপেটা ও কাদাঁনে গ্যাসের সেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নঈম মো. শহীদুল্লাহ জানান, ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এ আগুনের সূত্রপাত। তবে তদন্তের পরই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এই এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণ পানি না পাওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর মাহবুব সাংবাদিকদের জানান, সকালে ওই কারখানার তৃতীয় তলা থেকে শুরু করে অষ্টম তলা পর্যন্ত ৫টি ফ্লোর থেকে আরো প্রায় ৬৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া গেছে ৩য় ও ৪র্থ তলায়। তাদের দেহ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় চেনার উপায় নেই।
সকাল ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনীর ৯ম পদাতিক ডিভিশনের সেনাসদস্যরা।
বিজিএমইএ’র আশুলিয়া অঞ্চলের সিনিয়ার এঙিকিউটিভ অফিসার জাহানারা আক্তার জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। নিহতদের পরিবারের কাছে তা হস্তান্তর করা হবে বলে জানান তিনি।
দমকল বাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নঈম মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এ আগুন লাগে বলে আমরা ধারণা করছি। তবে তদন্তের পর এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এতো সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশপাশে যথেষ্ট পরিমাণ পানি না পাওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হয়েছে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, এ ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ মহা-পরিদর্শক মিজানুর রহমানকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। এছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়াও অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে এবং দায়ীদের চিহ্নিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এ এন শামসুদ্দীন আল আজাদ।
তিনি জানান, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (সার্বিক) আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটিতে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড, বিজিএমইএ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে এই কমিটিকে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কী কী করণীয়- সে বিষয়েও সুপারিশ করবে তদন্ত কমিটি।
প্রশাসন ও অর্থ বিষয়ক পরিচালক আব্দুস সালামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার ব্রিগেড কর্তৃপক্ষ।
বাহিনীর উপ পরিচালক ভরত চন্দ্র বিশ্বাস এই কমিটির সদস্য সচিব এবং মিরপুরের প্রশিক্ষণ কমপ্লেঙের ভাইস প্রিন্সিপাল বদিউজ্জামান, উপ সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা (ইপিজেড) আনোয়ার হোসেন সদস্য হিসাবে রয়েছেন।
কমিটির প্রধান সাংবাদিকদের জানান, তাদের সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
তোবা গ্রুপর ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী, ‘তাজরিন ফ্যাশন’ নামের কারখানাটি ছাড়াও মোট ১৩টি পোশাক কারখানা রয়েছে তাদের। এর মধ্যে ‘তাজরিন ফ্যাশন’ এ শ্রমিক-কর্মচারী মিলিয়ে দেড় হাজারের বেশি লোক কাজ করতেন।
এছাড়া নয় তলা এই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ফায়ার ফাইটার, উদ্ধারকর্মী ও প্রাথমিক চিকিৎসা কর্মী মিলিয়ে মোট ৩০০ কর্মী থাকার কথা বলা হলেও অগ্নি নির্বাপণে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতা। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম দেলোয়ার হোসেন।