গাদ্দাফির আহত ও গ্রেফতার হওয়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো প্রথম জানে গাদ্দাফি-বিরোধী এনটিসি-র মুখপাত্র মোহামেদ লেইথের কাছ থেকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেন, “বৃহস্পতিবার সকালে সিরত থেকে পালানোর সময় ন্যাটো বিমান হামলার শিকার হন গাদ্দাফি। এরপরই একটি বাঙ্কারে গা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেখান থেকেই গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে আটক করা হয়। তবে তখনও শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।” পরে গাদ্দাফির আটকের ব্যাপারে এন টি সি-র আরেক কর্মকর্তা আবদেল মাজিদ বলেন, “তাকে আটক করা হয়েছে। দুই পা গুলিবিদ্ধ। শুধু দুই পায়ে নয়, তার মাথায়ও গুলি লেগেছে।” একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান মাজিদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই এ খবরের সত্যতা মেলে যখন গাদ্দাফির গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহের ছবি টিভি পর্দায় প্রচার হওয়া শুরু করে। এন টি সি মুখপাত্র মোহামেদ লেইথও স্বীকার করেন, “গাদ্দাফি আর বেঁচে নেই।”
সংবাদসংস্থা আল-জাজিরা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার এন টি সি-র সেনারা গাদ্দাফির বাংকারে অতর্কিত হানা দেয়ার পর তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলে গাদ্দাফি এ টি সি সেনাদের উদ্দেশে ‘ডোন্ট শ্যুট, ডোন্ট শ্যুট’ বলে চিৎকার করছিলেন। কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত না করে এন টি সি সেনারা তাকে লক্ষ্য করে এলোপাথারি গুলি চালায়।
এন টি সি-র একাদশ ব্রিগেডের কমান্ডার আব্দুল হাকিম আল জলিল সংবাদসংস্থা রয়টার্স ও বৈরুতের ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিনিধিকে বলেন, তিনি গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ আবু বকর ইউনুস জব্বরের মৃতদেহও নিজের চোখে দেখেছেন। প্রমাণ হিসেবে জব্বরের রক্তাক্ত দেহের একটি ছবিও দেখান।
ঘটনা দুনিয়াজুড়ে চাউর হয়ে যাওয়ার পরই মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃতদেহ গোপন স্থান সরিয়ে ফেলে এন টি সি। নিরাপত্তার কারণে জায়গার নাম গোপন রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এন টি সি সেনা অফিসার আব্দুল মজিদ। মিসরাত শহর থেকে এন টি সি কর্মকর্তা মোহাম্মেদ আব্দুল কাফি জানান, “গাদ্দাফির দেহ আমাদের ইউনিটের একটি গাড়িতে রয়েছে এবং নিরাপত্তার কারণে আমরা তা গোপন একটি স্থানে নিয়ে যাচ্ছি।”
এদিকে মুয়াম্মার গাদ্দাফির জন্মশহর সিরতে পুরোপুরি দখল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার এন টি সি-র অনুগত সেনারা। শহরটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে লড়াই করে গাদ্দাফিবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল এন টি সি বাহিনী। তবে শহরটি পুরো দখলের পথে তাদের জন্য বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় গাদ্দাফিপন্থী স্নাইপাররা। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে এন টি সি সেনারা প্রায় ৯০ মিনিট লড়াইয়ের পর সর্বশেষ অবস্থান থেকে গাদ্দাফিপন্থীদের হটিয়ে দেয়ার কথা জানায়। শহরের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধাভিযানের দায়িত্বরত প্রধান কর্মকর্তা কর্নেল ইউনুস আল-আব্দালি বৃহস্পতিবার সকালে রয়টার্সকে বলেন, “অবশেষে সিরত মুক্ত। গাদ্দাফি সেনারা আর নেই। আমরা এখন পালিয়ে যাওয়া গাদ্দাফি অনুগত যোদ্ধাদের ধাওয়া করছি।”
তবে সিরতের উপকণ্ঠ থেকে বি বি সি-র সংবাদাতা সিরতের পতনের খবর নিশ্চিত করতে পারেননি। এন টি সি সেনারা জানিয়েছে, গাদ্দাফি অনুগত যোদ্ধাদের নিয়ে ৪০টি গাড়ি শহর ছেড়ে পশ্চিম দিকে গেছে। অন্যপ্রান্তে এন টি সি-র আরেক সেনা আব্দুল সালাম মোহাম্মদ জানান, গাদ্দাফির লোকজন পশ্চিমে পালালেও তাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। অন্তত ১৬ জন গাদ্দাফিপন্থী যোদ্ধাকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বি বি সি। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, বনি ওয়ালিদ শহরে এখনো গাদ্দাফি অনুগত গুটিকয়েক যোদ্ধার প্রতিরোধ লড়াই মোকাবিলা করতে হচ্ছে এন টি সি বাহিনীকে। যদিও ইতোমধ্যেই বনি ওয়ালিদ শহরের ৯০শতাংশ এলাকা দখল করেছে তারা।
চলতি বছর ২৩ আগস্ট রাজধানী ত্রিপোলির পতনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন ৪২বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা গাদ্দাফি। এরপর থেকে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যাচ্ছিল না।
১৯৬৯-এ ক্ষমতায় আসার পরই দেশে আমেরিকা-ব্রিটেনের দূতাবাস বন্ধ করে দিয়ে দেশী-বিদেশী তেল কোম্পানিগুলোর এক বড় অংশকে জাতীয়করণ করেন তিনি। আয়ারল্যান্ড-প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামে অর্থ-অস্ত্র সাহায্য করেছেন খোলাখুলি। এর আগেও আমেরিকান বিমান হানা দিয়েছে গাদ্দাফির ঘাঁটিতে, তাতে দমলেও হার মানেননি তিনি। কিন্তু, ২০০৩-এ সাদ্দামের পতনের পর চেহারাটা বদলাতে থাকে, তেলের প্রয়োজনে পশ্চিমী দুনিয়া গাদ্দাফিকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে, আর গাদ্দাফিও সুর নরম করেন। ইতালিসহ নানা দেশের সাথে বিপুল অংকের অর্থনৈতিক চুক্তি করেন গাদ্দাফি। ইউরোপের নানা জায়গায় ব্যাঙ্ক, পরিকাঠামো ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করে লিবিয়ার সরকারি সংস্থাগুলো।
পূর্ব লিবিয়ার তেলের খনিগুলোতে বিনিয়োগ ছিল চীনের। কোনো কোনো মার্কিন কূটনীতিক আবার সরাসরি চীনকে হটিয়ে তেল দখলের কথা মেনেও নিয়েছেন! ফলে, লিবিয়ার তেলের খনি দখল করাটা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ‘বিদ্রোহীদের রক্ষা করার মানবিক কর্তব্যের তাগিদে’ চলতি বছরের ১৯ মার্চ, হানাদারির প্রথম দিনই ১১০টি মিসাইল ছোঁড়ে মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী, দিনে দিনে বাড়ে আক্রমণের তীব্রতা, ৩১ মার্চ থেকে ‘অপারেশন ইউনিফায়েড প্রোটেক্টর’-এর দায়িত্ব নেয় ন্যাটোর জোটবাহিনী। শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুতেই না, অসামরিক বাসস্থানেও চলেছে অবাধে বিমান-মিসাইল হানা। প্রতি সেকেন্ডে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে নিহত-আহত-ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে গাদ্দাফি হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দেন, ‘বিজয় অথবা মৃত্যু’। শুরু হয় আরো নৃশংস হামলা।
বিদ্রোহী বাহিনীকে ট্রেনিং থেকে শুরু করে আধুনিকতম অস্ত্র, এমনকি কোথাও কোথাও নেতৃত্ব দিয়েছে ন্যাটোর বাহিনী। বিদ্রোহীদের একাংশ খোলাখুলিভাবেই বিদেশী শক্তিগুলোর হাতের পুতুল, একটা অংশ অবস্থান নিয়েছেন স্বাধীনভাবে গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পক্ষে।
আসলে, গাদ্দাফির যাবতীয় স্বৈরাচারিতা, দুর্নীতি সত্ত্বেও তেল কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া বিপুল লাভে গাদ্দাফির নিজের পরিবার ফুলে উঠেছে এমন অভিযোগও যেমন আছে, সেই সাথে বিনা ভাড়ায় সরকারি আবাস, বিনা খরচে শিক্ষা, বিনা খরচে চিকিৎসা, ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ, ছোট শহরের পরিকাঠামো, কৃষি আর ছোট শিল্পে ঋণ ইত্যাদিতেও কম খরচ করা হয়নি। এরই ফলে গোটা আফ্রিকার মধ্যে মাথাপিছু গড় আয় সবচেয়ে বেশি ছিলো এই লিবিয়ায়। স্বাক্ষরতার হার ৮৭ শতাংশ, ২০১১-র হিসেবে মানব উন্নয়ন সূচকে লিবিয়া গোটা পৃথিবীতে ৫৫ নম্বরে।
এই লিবিয়ায় এদিন এক ঐতিহাসিক দিন। গভীর রাত পর্যন্ত নিশ্চিত হতে না পারলেও উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেনি ন্যাটো। উল্লাস ছড়িয়েছে বৃটেন থেকে ওয়াশিংটন। সূত্র: ওয়েবসাইট।