এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে খরচ বেড়েছে জানিয়ে বর্তমান দরে ভোজ্য তেল বিক্রি সম্ভব হবেনা বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যাপারে সরকার ব্যবস্থা না নিলে রমজান মাসে ভোজ্য তেলের সংকট এবং মূল্য বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। বর্তমানে সাড়ে তিন লাখ টন চাহিদার বিপরীতে প্রায় দেড় লাখ টনের ঘাটতি আছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ গোলাম হোসেনের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। রমজান মাসে ভোজ্য তেল ও চিনির বাজার স্বাভাবিক রাখতে করণীয় নির্ধারণে চট্টগ্রামের ভোজ্য তেল ও চিনি আমদানিকারক, পরিশোধক ও উৎপাদকদের সঙ্গে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
বৈঠকে চট্টগ্রামের অন্যতম ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও মিল মালিক এস এ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম বলেন, ডলার সংকটের কারণে ভোজ্য তেলসহ সহ অন্যান্য ভোগ্য পণ্য আমদানির জন্য সরকারি-বেসরকারি কোন ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছেনা। এ অবস্থায় সময়মতো ঋণপত্র খুলতে না পারলে রমজানের আগে বিদ্যমান দেড় লাখ টন ভোজ্য তেলের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবেনা।
এছাড়া গত এক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন ও পামঅয়েল উভয় ক্ষেত্রে প্রতি টনে ৫০ থেকে ৬০ ডলার বেড়ে যাওয়া এবং প্রতিমুহুর্তে বাংলাদেশে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদক ও পরিশোধকদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় খরচ পোষাতে হলে মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া কোন উপায় নেই।
সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাজার বাজারের গতিতেই চলবে। এটা রোধ করার কোন উপায় নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব আমাদের উৎপাদন খরচকে হিট করছে। আগামী তিন/চার দিনের মধ্যে ভোজ্য তেলে মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে জানান তিনি।
বর্তমানে শুধু একটি জেটি দিয়ে তেল খালাস হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভোজ্য তেল খালাস ও ডেলিভারির জন্য আরো একটি জেটি বরাদ্দের আহবান জানিয়েছেন তারা। এছাড়া দীর্ঘ দিনের ডিও প্রথার পরিবর্তে পরিবেশক প্রথা চালুর ক্ষেত্রে সরকারকে আরো নমনীয় হওয়ার আহবান জানান তারা। না হলে চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হবে বলে জানান তারা।
ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন বলেন, আসছে বাজেটে ভোজ্য তেলের উপর সুনির্দিষ্ট শুল্ক নির্ধারণ করা হবে। পণ্যের মূল্য না, পরিমাণের উপর বাজেটে শুল্ক নিধার্রণের ঘোষণা দেয়া হবে। ভোজ্য তেলের মজুদ ঘাটতি থাকলেও আগামী দুই মাসে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ভোজ্য তেলের বিদ্যমান ঘাটতি থাকবে না আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এতটুকু আস্থা ও বিশ্বাস ব্যবসায়ীদের উপর সরকারের আছে। এসময়ের মধ্যে ঋণপত্র খোলার সমস্যাও থাকবেনা বলে তিনি দাবি করেন। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান তিনি। এরপরেও তিনি এ সমস্যার কথা গভর্নরকে জানাবেন।
তবে এব্যাপারে ব্যবসায়ীদের স্ববিরোধী অবস্থান রয়েছে উল্লেখ করে বাণিজ্য সচিব বলেন, অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন তাদের ঋণপত্র খোলার কোন সমস্যা নেই।
আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী তেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ার কোন যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা হবে।
পরিবশেক প্রথা চালুর প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা সমস্যা হলেও আগামী ১জুন বুধবার থেকে সীমিত পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে পরিবশেক প্রথা চালুর জন্য মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি আহবান জানান তিনি। এসময় যেসব সমস্যা হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের যৌথ মনিটরিংয়ে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে চালু থাকা ডিও প্রথার অপব্যবহার হয়েছে উল্লেখ করে গোলাম হোসেন বলেন, এ প্রথার অস্বচ্ছতা থেকে বেরিয়ে আসতে পরিবেশক প্রথা চালু করা হয়েছে। টিসিবিকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণের বিকল্প হিসাবে সরকার পরিবেশক প্রথা চালু করেছে বলে জানান তিনি।
অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের শুল্কহার ১০ শতাংশ।
ভোজ্যতেলে কিছুটা মজুদ ঘাটতি থাকলেও চিনির মজুদ সন্তোষজনক উল্লেখ করে সভায় বাণিজ্যসচিব বলেন , চিনি নিয়ে চিন্তার কিছু দেখি না।
ছোলা, ডালসহ অন্যান্য পণ্য যথেষ্ট সরবরাহ আছে উল্লেখ করে রমজানে সংকট হবেনা বলে তিনি জানান। সভায় বাণিজ্য সচিব রমজানে সরবরাহ কাঠামোর প্রস্তুতি ও পরিবেশক নিয়োগের অগ্রগতি নিয়েও ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি জানতে চান। কে কতজন পরিবেশক নিয়োগ করেছেন সেটার তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়ার আহবান জানান বাণিজ্য সচিব।
ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর কোন সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে মিডিয়ায় সেটা প্রচার করার জন্য ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করেন বাণিজ্য সচিব।
এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক সংবাদ পরিহার করে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীদের দায়িত্বশীল ভুমিকা পালনের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, এ দেশ শুধু ব্যবসায়ী বা সরকারী কর্মকর্তার না সবার। সেটা কারো ভুলে গেলে চলবেনা।
সভায় এফবিসিসিআইয়ের পণ্য মূল্য মনিটরিং সেলের কো-চেয়ারম্যান ও সংগঠনের পরিচালক হেলালউদ্দিন ঋনপত্র খোলার সমস্যা এবং ডলারের বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন , রমজান দোরগোড়ায়, এ সমস্যা সমাধান করতে না পারলে রমজানে পণ্য মূল্য সহনীয় রাখা যাবেনা।
প্রচলিত বাজার দরের চেয়ে টিসিবি’র কম মূল্যে পণ্য বিক্রির বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু সরকারি কোন এজেন্সি প্রতিযোগিতায় আসলে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে টিসিবিকে বাজারের নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বলেন।
এছাড়া রমজানের আগে সব পণ্যের সরবারাহ, মজুদ পরিস্থিতি ও খরচ পর্যালোচনা করে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলেন তিনি।
টিসিবি খোলাবাজারে যেসব পণ্য বিক্রি করবে সেগুলোর মূল্য প্রচলিত বাজারের সমান রাখার ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, টিসিবিকে লাইফ সাপোার্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, টিসিবি এখন মৃতপ্রায়। একে ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগী ভাবার কোন কারণ নেই। টিসিবিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হলে লোকবল নিয়োগ সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এটি সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সভাপতি মাহবুবুল আলম বর্তমানে চট্টগ্রামের পাইকারীবাজারে ছোলা , ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ভালো উল্লেখ করে দাম সহনীয় রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দেন।
পাইকারি বাজার থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য নেয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হয়রানি না করার অুনরোধ জানান তিনি। পরিবেশক প্রথা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে ২১ জুন থেকে এই প্রথা পুরোপুরি চালু করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
এস এ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগ্য পরিবেশক পাওয়া যাচ্ছেনা উল্লেখ করে প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে পরিবেশক প্রথা একযোগে কার্যকর করা সম্ভব নয় বলে জানান। শত বছরের পুরানো প্রথা থেকে নতুন ট্র্যাকে আসতে সরকারকে নমনীয় থাকার আহবান জানান তিনি। প্রথম পর্যায়ে জেলা ও উপজেলায় পরিবেশকদের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা হলে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ধীরে ধীরে চালু করার কথা বলেন।
ছোট আমদানিকারকরা কীভাবে পরিবেশক নিয়োগ করবে এ ব্যাপারে বাণিজ্য সচিবের নির্দেশনা চান চট্টগ্রামের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মাসুদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক আবুল বশর। ওএমএসে অনেক কম দামে চাল বিক্রির কারণে ব্যবসায়ীদের বেশি দামে কেনা চাল প্রতি কেজিতে ৭ টাকা লস দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি ওএমএস বন্ধের দাবি জানান।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংক সুদের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ রাখার সরকারী নির্দেশনা থাকলেও ব্যাংকগুলো সেটি মানছেনা।
এর জবাবে বাণিজ্য সচিব বলেন আমরা এটি নিয়ে ফাইট করছি। তবে ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক সুদের হার নমনীয় রাখতে নির্দেশা দেয়া হয়েছে বলে জানান এফবিসিসিআই পরিচালক।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সিরাজুল হক খান, জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (আমদানি) গোলাম কিবরিয়া , চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক নুরুল আলম, নূরজাহান গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ, টিকে গ্রুপের পরিচালক তারিক আহমেদ, মোস্তফা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলামসহ অন্যান্য গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।