তিনি বলেন, “পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতরাও প্রণীত প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ পড়েন না। সাধারণত যে যে অংশের সঙ্গে জড়িত সেটুকুই পড়েন। ফলে পরিকল্পনার বিষয়বস্তুর মধ্যে নানান অসঙ্গতি দেখা যায়।” তিনি বলেন, “আমাদের দেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাংলায় না হয়ে ইংরেজিতে রচিত হয়। ইংরেজিতে রচনার মধ্য দিয়ে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, পরিকল্পনা কাদের জন্য? দেশের ৭০ ভাগ সংসদ সদস্য ইংরেজি পড়ে বোঝেন না। মন্ত্রীদের অনেকেও ইংরেজি বুঝেন না। আর ১৬ কোটি জনগণের এক শতাংশও বুঝতে পারে না। আসলে আমাদের দেশে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদিত হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের জন্য প্রণয়ন করার মানসিকতা নিয়ে তৈরি হয়নি।”
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির উদ্যোগে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো, টার্গেট, কৌশল ও অর্থায়ন বিষয়ের ওপর দু’দিনের এক সেমিনারের প্রথম দিনে তিনি এসব কথা বলেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ। উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন-ড. ফেরদৌস আরা বেগম, অধ্যাপক মোয়াজ্জাম হোসেন খান ও মুজিবুর রহমান।
আবুল বারাকাত বলেন, “ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকীর উপক্রমনিকায় দারিদ্র্য হ্রাস ও অচিরেই দারিদ্র্য উচ্ছেদের কথা বলা হলেও মূল প্রতিবেদনের ভিতরে কোথাও এ নিয়ে আলোচনা করা হয় নি। আমরা জানিনা এ পরিকল্পনার দার্শনিক ভিত্তি কী? নয়া উদার দর্শন নিয়ে রচিত এ পরিকল্পনায় বৈষম্যকে এড়িয়ে চলা হয়েছে। বৈষম্য বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অর্জন করলেও কোনো লাভ হবে না। তিনি পরিকল্পনা প্রণয়নে দার্শনিক ভিত্তি বাংলাদেশের সংবিধান ও ভিশন-২১কে সামনের রাখার পরামর্শ দেন।”
আবুল বারাকাত বলেন, “মধ্যম আয়ের দেশ নয়, বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। বর্তমান সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিস্থাপিত হওয়ায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উদার, সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক দেশ।”
আবুল বারাকাত বলেন, “সংবিধানে সকল ক্ষমতার উৎস জনগণের হাতে থাকলেও সবচেয়ে কম ক্ষমতাবান হলো জনগণ। তারা নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ক্ষমতা পেলেও পরে তারাই সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। তিনি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে ভাড়া করা পরিভাষা বাংলাদেশে ব্যবহারের ঘোর আপত্তি জানান।”
আবুল বারাকাত বলেন, “দেশে বেকার মানুষ কতো তা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকীতে উল্লেখ করা হয়নি। কম আয়ের লোকদের জন্য উৎপাদন বাড়ানো কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু উৎপাদন বাড়লে দুর্ভিক্ষ কমে না। অর্থনীতিবিদ অমর্ত সেনের এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে যখন যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে তখন সে দেশে আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছিল। আসলে উৎপাদনের ন্যায্য বিতরণ ছাড়া গরিব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে না।”
আবুল বারাকাত জাতীয় শিক্ষানীতির বিষয়ে বলেন, “দেশের তিনজন শিক্ষার্থীর একজন মাদ্রাসার ছাত্র। দেশে ৫২ লাখ কওমী মাদ্রাসার ছাত্র রয়েছে। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে কওমি মাদ্রাসার ব্যাপারে একটি কথাও বলা হয়নি।”
কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ বলেন, “আমাদের টার্গেট একটা কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা। কী ব্যবস্থায় অর্থনীতি চালিয়ে যাবো? আমরা কী বিশ্ব ব্যবস্থার বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করবো? দেশের বর্তমান কাঠামোতে সাধারণ মানুষ ন্যায্যভাবে অর্থনীতিতে কম অংশগ্রহণ ও ফল ভোগ করছে।”
খলিকুজ্জামান বলেন, “বিশ্ব ব্যবস্থায় অর্থনীতি যেভাবে চলছে তাতে কিছু মানুষ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে আবার কিছু মানুষ অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যবস্থার এই নীতি গ্রহণ করলে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “মধ্যম আয়ের দেশের সংজ্ঞায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল কৃষিতে জোর দিতে, শহরের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে এবং বিনা শর্তে বাজার খুলে দিতে হবে। বিশ্ব ব্যাংকের মতামতের ভিত্তিতে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। খোলা বাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাছে মার খেয়ে যাবে।”