অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এক-দুই মাসে সম্ভব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। তবে সরকার মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে সব রকম পদক্ষেপই নিচ্ছে বলে দাবি তার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ৭ মাত্রার নিচের মূল্যস্ফীতিকে স্বাভাবিক ও সহনীয়; ৭ মাত্রার মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য সতর্ক সঙ্কেত এবং এর উপরের মাত্রার মূল্যস্ফীতিকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও ৯ মাত্রার মূল্যস্ফীতিকে মহাসতর্ক সঙ্কেত বলে মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশের (১১.৯৭) কোটা স্পর্শ করেছে। আগস্টে এটি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছর সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৬১ শতাংশে। গত এক দশকে দেশ মূল্যস্ফীতির এ হার নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রেকর্ড স্পর্শ করেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, আগামী ২০১৭ সালের মধ্যে বেকারত্ব, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনারও পরিকল্পনা করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষে সরকার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করছে বলে জানা গেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারের এ সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তারল্য সঙ্কট, রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়া, পুঁজিবাজারে দুরবস্থা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট, বাজারব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা, পরিবহণ ব্যবস্থায় নৈরাজ্য, দক্ষতার অভাব ও ভবিষ্যতে সম্ভাব্য অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সিন্ডিকেট, কালোবাজারী ও মজুদদারদের শনাক্ত করার মাধ্যমে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হওয়াসহ হঠাৎ করেই যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে দেশজুড়ে হইচই পড়ে যাওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ও সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।
এ অবস্থায় প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বব্যাংকের অর্থছাড়ের প্রস্তাব প্রত্যাহার অর্থনীতির পায়ে আরেকটি শেকল পরিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে জানান, মূল্যস্ফীতি এ মুহূর্তে দেশে প্রধান সমস্যা। এছাড়া অবকাঠামোর উন্নয়ন, দক্ষতার উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতির এ নিয়ামকগুলোর উন্নয়ন ছাড়া কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে মানুষের নাভিশ্বাস বাড়লেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ পদক্ষেপ না থাকায় এর উত্তাপে ক্রমাগত পুড়ছে মানুষ। নিম্নবিত্তের কোটা ছাড়িয়ে তা মধ্যবিত্তেও আঘাত হানতে শুরু করেছে। তৈরি হচ্ছে শ্রেণী বৈষম্য; ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বয়স পৌনে তিন বছর পেরিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরো অস্থির করে তুলবে। এতে বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও টাকা খাটাবে না। শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকলে কিংবা উৎপাদন কম হলে কর্মসংস্থান হারাবে মানুষ।
তারা আরো বলছেন, এতে করে আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অর্জিত হওয়া তো দূরের কথা, চলতি অর্থবছরেও ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সরকারের জন্য।
ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম জানান, শুধু দেশজ উৎপাদন ও সম্পদ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যাবে না। এর জন্য বিনিয়োগের হার বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবাহের ধারাবাহিক বৃদ্ধিও ধরে রাখতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক ও রাজনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদনমুখী বৃহৎ শিল্পায়নের পাশাপাশি ৰুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার ঘটাতে হবে। এতে দেশী-বিদেশী সব ধরনের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে কিংবা শিল্পোদ্যোক্তাদের এ ক্ষেত্রে আকৃষ্ট করতে হলে অবকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন করতে হবে। বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে এ লৰ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে শীর্ষ এ বাণিজ্যিক সংগঠনটির সভাপতি এ.কে. আজাদ বলেন, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে আগামীতে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। এ বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগ শুধু দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। বিপুল পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগকেও আকৃষ্ট করতে হবে।