গত ২৯ জুলাই ইকোসকে স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার লারস অ্যান্ডারসন বায়েরের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এমন কথা বললে ভারত, পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়াসহ ৭টি দেশ বাংলাদেশের ওই বক্তব্য সমর্থন করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি অণুবিভাগের একজন মহাপরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে রোববার এ কথা বলেন।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে এ মোমেন এ বিষয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটির স্বচ্ছতা, নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। বাংলাদেশ তার অভিযোগ জানিয়েছে, তা গ্রহণ করা হয়েছে।’
এ কে এ মোমেন বলেন, ‘আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম তার কাজের পরিধিকে ছাড়িয়ে গিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। বাংলাদেশের নতুন বসতি স্থাপনকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম একটি দেশের রাজনৈতিক ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করছে যা ফোরামের এখতিয়ারে নেই।’ এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ওই মহাপরিচালক বলেন, ‘ইকোসকে লারস অ্যান্ডারসন তার প্রতিবেদন জমা দিলে বাংলাদেশ ২টি বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমত, লারস অ্যান্ডারসন পরিচয় গোপন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের মতো একটি এনজিও’র হয়ে বাংলাদেশ সফর করেন এবং তার প্রতিবেদন অস্বচ্ছ। দ্বিতীয়ত, শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়োগ না করা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত দেওয়া বা কথা বলা ইকোসকের আওতার মধ্যে পড়ে না।’
এ দু`টো বিষয় ইকোসক ‘নোট’ করে এবং তা ওই প্রতিবেদনের সঙ্গেই সংযুক্ত করে রাখা হয় জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, চীন, মরক্কো, সৌদি আরব ও মেক্সিকো বিষয়টিতে বাংলাদেশের অবস্থানের স্বপক্ষে নিজেদের মত প্রদান করে।’ তিনি বলেন, ‘ইকোসকের ওই ফোরামটি মানুষ ও সংগঠন নিয়ে জাতিসংঘের একটি ফোরাম। এতে কোনও রাষ্ট্রের বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলক কোনও বক্তব্য দিতে পারে না। এছাড়া আদিবাসী বা উপজাতি বিষয়ে তো জাতিসংঘ কোনও দেশকে সিদ্ধান্ত দিতেই পারে না। এটি কোনও রাষ্ট্রের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি জানান, ইকোসকের বৈঠকে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকান ও ক্যারিবীয় গ্র“প, ওআইসি, পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সংশোধনী প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছেন।
মেক্সিকো, ভারত, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মরক্কো বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স প্রক্রিয়াগত জটিলতার অজুহাত দেখালেও বাংলাদেশের উদ্বেগ ও স্পর্শকাতরতাকে স্বীকার করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক এ ব্যাপারে জানান, ‘ইকোসকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে না রাখা বিষয়ক ইস্যুতে অ্যান্ডারসনের প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিবাদ জানায় মরক্কো ও সৌদি আরব।’ এছাড়া ভারত ও পাকিস্তান তাদের মন্তব্যে বলে, ‘ভারতীয় উপ-মহাদেশে আদিবাসী নেই, এখানে উপজাতি রয়েছে।’ চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের সমর্থনকালে বলে, ‘কোনও দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপার নিয়ে এধরনের অস্বচ্ছ প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।’
প্রসঙ্গত, গত ২০১০ সালে লারস অ্যান্ডারসন বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন। চলতি মাসের ২৯ তারিখে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইকোসকের বৈঠকে বিষয়টি তিনিন উত্থাপন করেন। এতে তিনি পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা না নেওয়ার সুপারিশ করেন।
এদিকে বাংলাদেশের আপত্তি সত্বেও ইকোসকে লারস এন্ডারস বায়েরের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হওয়াকে ইতিবাচক ও ‘আদিবাসী’ হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া বলে মনে করছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ফোরাম ও তাদের নেতারা। ইকোসকের বৈঠকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিষয়ক জাতিসংঘের প্রতিবেদন বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।
রোববার রাতে তিনি বলেন, ‘দেশের সংবিধানে এবং জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে চর্চা হলো, তাতে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হল।’
চাকমা রাজা বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রাান্তিক ও অনগ্রসর এক দশমিক দুই শতাংশ মানুষ তাদের প্রান্তিক অবস্থান জানানোর একটি আইনি ভিত্তি পাবে।’
পার্বত্য শান্তিচুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে দেবাশীষ রায় বলেন, ‘পার্বত্যাঞ্চলসহ এদেশের আদিবাসীরা ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত। এ কারণে আমরা শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তসমূহ যথাযথ বাস্তবায়ন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দানের পাশাপশি প্রান্তি আদিবাসী জনগোষ্ঠির বিশেষ সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আদিবাসীর স্বীকৃতি দিলে বাঙালিরা বহিরাগত হয়ে যাবেন, এমনটি ভাবার কোনও অর্থ নেই।’