নিউইর্য়ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারে সমর্থন দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য এ বিচার প্রয়োজন। এ বিচারের সফল সমাপ্তি যুদ্ধের ক্ষত মুছে দিয়ে বাংলাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে।
শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ আহ্বান জানান তিনি। জাতিসংঘ সদর দফতরে স্থানীয় সময় বিকাল পৌনে ৪টায় (বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ২টা) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ভাষণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা প্রণয়ন জাতিসংঘের প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য একটি কঠিন কাজ। একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধ ও টেকসই বিশ্ব গড়তে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের সবার আকাঙক্ষা পূরণ হবে। কোনো ব্যক্তি বা জাতি পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও উদার ১৬ কোটি মানুষ সামনে থেকে এসব প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আমাদের জাতির ধর্ম অসাম্প্রদায়িক কাঠামো ধ্বংস করতে অতি সক্রিয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মাধ্যমে তাদের এ ধ্বংসাত্মক তৎপরতার শুরু হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একত্রে এক সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। এ চক্র তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে তারা তাকে হত্যার উদ্দেশে উপর্যুপরি ১৩টি গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ২৪ নেতাকর্মী নিহত এবং ৫ শতাধিক আহত হয়। এ হামলায় অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও দলের সিনিয়র ও নিবেদিত নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ অনেক নিরাপরাধ মানুষ ও অসাম্প্রদায়িক নেতা নিহত হন। এসব ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জঙ্গিবাদবিরোধী ও অর্থ পাচারবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখেরও অধিক মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে। তখন থেকে দালালদের বিচারের আওতায় আনতে জাতি গভীর আশা ও আকাঙক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য তার সরকার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আওতায় দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এই বিচারকাজ পরিচালনায় সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হয়ে দেশে শান্তি ও অগ্রগতি চিরস্থায়ী রূপ নেবে। তিনি এ উদ্যোগকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী ৩৯ বছর আগে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতিসংঘে দেয়া ভাষণের উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন এ মঞ্চে দাঁড়িয়েই নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। যেখানে শান্তি, ন্যায়বিচার ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে, যার মাধ্যমে বিশ্ব ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও যুদ্ধমুক্ত হবে। ‘বঙ্গবন্ধুর সেই লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে পেরে তার কন্যা হিসেবে আমি গর্বিত’।
তিনি বলেন, নিত্যনতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। এসব আবিষ্কার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে অবদানের পাশাপাশি দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করছে, যা অনেক সময় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্বের অরক্ষিত, বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ জাতি-গোষ্ঠী।
প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘২০১৫-পরবর্তী এজেন্ডা : প্রস্তুতি গ্রহণ’ ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ নির্ধারণে সহায়তা করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০০০ সালে ‘সহস্রাব্দ ঘোষণা’ গ্রহণের সময় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার উপস্থিতি, ২০১০ সালে এমডিজি অগ্রগতি পর্যালোচনায় উপস্থিতি এবং এবার এমডিজি থেকে ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডায় উত্তরণেও তার অংশগ্রহণে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত লক্ষ্য এবং এগুলো অর্জনে প্রয়োজনীয় সম্পদের পরিমাণসহ বাংলাদেশ ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা জাতিসংঘে উপস্থাপনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমডিজির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যেও কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ এমডিজি-১, ২, ৩, ৪, ৫ ও এমডিজি-৬ পূরণ করেছে বা কোনো কোনো লক্ষ্য পূরণের পথে রয়েছে এবং দেশে দারিদ্র্য হার ১৯৯১ সালের ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, গত সাড়ে ৪ বছরে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ৫ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে। রফতানি আয় ২০০৬ সালের ১০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৭ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রেমিট্যান্স ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৬ সালের ৩২০০ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ৯ হাজার ৫৯ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে এখন ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল’ এবং ‘দক্ষিণ এশিয়ার মান বাহক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড এবং এফএও ফুড অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ লাভ করেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে আমার উত্থাপিত ও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন মডেল’-এ বর্ণিত নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এ গৌরব অর্জন সম্ভব হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে তার ভিশনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ‘স্টেট অব আর্ট’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল সুবিধাসমৃদ্ধ ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র থেকে গ্রামের জনগণ দুই শতাধিক সেবা নিতে পারছে। গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত প্রায় ১৫ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে উন্নত চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও গ্রামের নারীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারছে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। দেশে ১০ কোটির বেশি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব, তার এই বিশ্বাসের উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন এবং ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষাই প্রধান চালিকাশক্তি। নারীর ক্ষমতায়ন এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কেবল প্রত্যাশিত অগ্রগতি সাধন সম্ভব। এজন্য নতুন শিক্ষানীতিতে মেয়েদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করা হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের ১ কোটি ১৯ লাখ শিক্ষার্থী মাসিক উপবৃত্তি পাচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৪ হাজারের বেশি নারী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন। বর্তমান সংসদে ৭০ জন নারী সংসদ সদস্য আছেন। ৫ জন নারী মন্ত্রী এবং একজন নারী সংসদের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা নারী। সরকারি চাকরিতে নারীর জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ তাদের বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চতর পদে পৌঁছাতে সহায়তা করছে।
তিনি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচির উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান সরকারের জনগণের ক্ষমতায়নে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি, ভিজিডি, ভিজিএফ, বাস্তুহারাদের বাসস্থান ও জীবিকা নির্বাহের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, ৪২ লাখ ৯৮ হাজার মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান এবং ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ লাখ ৩৮ হাজার গ্রামীণ মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রয়াস বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধীদের আত্মকর্ম সংস্থানের জন্য শিক্ষাদান, দক্ষতা উন্নয়ন এবং সুদবিহীন ঋণ দেয়া হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের এক শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। অটিজমসহ মানসিক প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বিশ্ব সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৭তম অধিবেশনে উত্থাপিত বাংলাদেশের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অটিস্টিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের অত্যাসন্ন চ্যালেঞ্জের প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অনেক অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাওয়ার অভিঘাত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সমুদ্রের পানির স্তর ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে এবং অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে, যা দেশে এবং দেশের বাইরে এক মানবিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি জলবায়ুজনিত অভিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি আইনি কাঠামো তৈরির জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে দেয়া তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে ‘জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল’-এ পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকারমূলক কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানান।
মহান ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী একইভাবে জাতিসংঘের প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার আহ্বান জানান। তিনি তার এ প্রত্যাশা চলতি অধিবেশনে প্রস্তাব আকারে উত্থাপনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে শান্তি, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের বাহন হিসেবে বিশ্বের সব মাতৃভাষা সুরক্ষায় তার এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি জাতিসংঘের বাংলা ওয়েবসাইট ও একটি রেডিও অনুষ্ঠান চালু এবং ইউএনডিপি এশিয়া রিপোর্ট বাংলায় প্রকাশ করায় জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাংলাকে জাতিসংঘের একটি অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
গত ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার সময় থেকে তার সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এসব লক্ষ্য অর্জনে নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার ও তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত পৌনে ৫ বছরে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের ৫ হাজার ৭৭৭টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ৬৩ হাজার ৯৯৫ জন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। কোথাও কোনো অভিযোগ ওঠেনি। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম।
বিদেশ নীতি বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের রূপরেখা বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করা, আঞ্চলিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করা এবং বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে শান্তিকে স্থায়ী রূপ দিতে কাজ করছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সর্বোচ্চসংখ্যক সৈন্য প্রেরণকারী এবং নিরস্ত্রীকরণ ও বিস্তাররোধ এজেন্ডায় সুদৃঢ় অবস্থানের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের এ অঙ্গীকার প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি বলেন, এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তার প্রধানমন্ত্রীত্বেরকালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ব্যাপকভিত্তিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি এবং মানববিধ্বংসী মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তি অনুসমর্থন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে বাংলাদেশের ভূমিকা ন্যায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং নিরস্ত্রীকরণকে সমর্থন করে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব পরিচিতির জন্য সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ২০১৫-পরবর্তী সময়ে শান্তি ও উন্নয়নে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, আন্তঃবিশ্বাস ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপকে উৎসাহিত করা জরুরি।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত বৈদেশিক সহায়তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি অর্জন এবং ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো পূরণে উন্নয়ন সহযোগীদের অফিসিয়াল উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে তাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ওডিএ হিসেবে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ দেয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
তিনি এলডিসিগুলোর পণ্য অন্যান্য দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্তভাবে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ব্রেটন উডস্ ইনস্টিটিউশনস ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মতপ্রকাশে সমান অধিকার এবং জিএটিএস অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অবাধ যাতায়াতের নিশ্চয়তা দিতে হবে।